Home » ফেসবুক বনাম বাস্তবতা

ফেসবুক বনাম বাস্তবতা

by প্রিয় দেশ ডেস্ক:

আজকাল ‘ম্যানেজ’ করে বা তাল মিলিয়ে চলতে পারা, সুন্দর সুন্দর কথার আবরণে নিজের চারিত্রিক দোষকে ঢেকে রাখা, ন্যায়নীতি ও আদর্শ বিসর্জন দিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অপরকে কৌশলে প্রতারণায় ফেলা ইত্যাদিকে ‘বুদ্ধিমত্তা’, ‘দূরদর্শিতা’ ও ‘বিচক্ষণতা’ ভাবা হয়। অনেকে এই কাজটি অত্যন্ত সচেতনভাবে করে। অনেকে আবার নিজেকে বৃহৎ-মহৎ হিসেবে নিজেকে উপস্হাপন করে। বিশেষ করে ফেসবুকে। প্রতিদিনের কার্যকলাপ ফেসবুকে জানান দেওয়া এখন যেন অনেকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কে কতটা আনন্দের সঙ্গে জীবন কাটায় তার যেন প্রতিযোগিতা চলছে। ফেসবুকে সবাই ভালো ভালো কথা বলে। সুন্দর সুন্দর বাণী উপহার দেয়। ফেসবুকে বিভিন্ন জনের কথা পড়লে, ছবি দেখলে মনে হয় না দেশে কোনো খারাপ মানুষ আছে। কারো মধ্যে দুঃখ-হতাশা যন্ত্রণা আছে। ফেসবুকে সবাই মহত্, সবাই সুন্দর। সবাই সুখী।

কিন্তু বাস্তবে মানুষ এত সুন্দর বা মহত্ নয়। অনেকের ব্যক্তিগত জীবনযাপন আর ফেসবুকের জীবন যাপনের মধ্যে ফারাক আকাশ-পাতাল। অনেকের ফেসবুকে দেখানো ভালো মানুষের চেহারাটা খসে পড়ে বাস্তব জীবনে। ফেসবুকে আমরা খুঁজে পাই ভণ্ডামির অসংখ্য কাহিনি।

কক্সবাজারে এক নারী পর্যটক ধর্ষণের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি আশিকুল ইসলামের কথাই ধরা যাক। সে কক্সবাজার পৌরসভার বাহারছড়া এলাকার একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, নারী নির্যাতনসহ নানা অভিযোগে ১৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ছিনতাই মামলায় সে জেল খেটে বের হয়েছে ৮ ডিসেম্বর। এই ১৬ মামলার আসামির ফেসবুক জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন রকমের ভালো ভালো কথা ও উপদেশ। ফেসবুক যে মানুষের প্রকৃত চরিত্র তুলে ধরে না, তার সেরা উদাহরণ যেন এই আশিকুল।

গত ২৮ মে সে নিজের একটি ছবি দিয়ে সেখানে লিখেছে, ‘জীবনটাকে সুন্দর করতে হলে, দুষ্টু লোকের ছায়া থেকেও দূরে থাকতে হবে। না হলে…(এর পর সে চারটি ইমোজি ব্যবহার করেছে।)

১৭ এপ্রিল সে লিখেছে, ‘বিদেশে যাইতে লাগে বিমান, আর জান্নাতে যাইতে লাগে পারফেক্ট ইমান।’ ১৪ এপ্রিল লিখেছে, ‘সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজেকে চেনা এবং সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে অন্যদেরকে উপদেশ দেওয়া।’

২০ জুন লিখেছে, ‘অতীতের সবকিছু ভুলে, সত্পথে থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে মহান আল্লাহর নামে শুরু করলাম, আমার জন্য দোয়া করবেন সবাই।’ ২৭ জুন তিনি দোয়া চেয়ে আবার লিখেছে, ‘প্রত্যেক মানুষের একটা অতীত থাকে, আমারও একটা অতীত ছিল, আমি আর সেটা নিয়ে একটুও চিন্তা করতে চাই না, এখন শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই, সকলের সহযোগিতা এবং দোয়ার আর্জি প্রার্থনা করছি।’

গত ২১ নভেম্বর সে লিখেছে, ‘হারাম থেকে বেঁচে থাকো, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবে!’

উল্লিখিত বক্তব্যগুলো পড়লে যে কেউই এই আশিকুলকে একজন ইমানদার মহাপুরুষ বা সাধুপুরুষ মনে করবেন। ধর্ষণসহ ১৬ মামলার একজন আসামি এমন কথা বলতে বা লিখতে পারে, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তা আশিকুল এসব কথা লিখেছে। আশিকুলের মতো অনেকেই এমন ভালো কথা লেখে, কিন্তু খারাপ খারাপ কাজ করে। বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে সাধু আর শয়তান এখন একই ধরনের বুলি কপচায়। বুলি শুনে বোঝার উপায় নেই, কে সাধু আর কে শয়তান। মার্ক জুকারবার্গের কল্যাণে এখন সবারই একটা করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। এই ফেসবুকে সবাই এখন ভালো ভালো কথা চর্চা করে। ফেসবুকে ভালো ভালো কথা বলে কিন্তু বাস্তবে খারাপ খারাপ কাজ করে।

এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে। ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ল দুই ডাকাত। জেলে বসে দুই ডাকাত আলাপ করছে।

প্রথম ডাকাত :বুঝলাম না! পুলিশ আগে থেকে খবর পেল কী করে!

দ্বিতীয় ডাকাত :আহ্হা! এইমাত্র মনে পড়ল। অভ্যাসবশত ফেসবুকে নিজের আপডেট দিতে গিয়ে গতকালকে ডাকাতির প্ল্যানটা স্ট্যাটাস দিয়ে ফেলেছি ভুল করে।

বাস্তব জীবনে অবশ্য চোর-ডাকাত-গুন্ডা-বদমাশ-লম্পটরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে কোনো খারাপ কাজ করে না। তারা বরং উলটো লিখে। আশিকুলের ফেসবুক পোস্ট সেই সত্যই জানান দেয়। বিজ্ঞানপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন চোর, ডাকাত, খুনি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ, লম্পট, নেশাখোর, প্রতারক, মলমপার্টি, অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, মাদক ব্যবসায়ী, জুয়াড়ি, মিথ্যাবাদীসহ যত খারাপ মানুষ আছে, তারা সবাই ফেসবুক চালায়। ফেসবুকে সবাই সততার পোস্ট দেয়। নিজের সততার গান গায়। আর সেখানে আরো কিছু ভালো-মন্দ মানুষ সহমত, শুভকামনা কিংবা অভিনন্দন লিখে কমেন্ট করে। প্রকৃতপক্ষে কে কতটা ভালো তা ফেসবুকে কখনো বিচার করতে পারবেন না। প্রোফাইলে ‘আল্লাহু’ লেখা ছবি ঝুলিয়ে সারা দিন ইউটিউবে অশ্লীল ভিডিও দেখা পাবলিককে আপনি কী বলবেন? কীভাবেই বুঝবেন সে মন্দলোক? আর আমরা এটা বুঝতেও চাই না। যেহেতু সে আল্লাহু লেখা ছবি প্রোফাইলে রেখেছে, সেহেতু সে ধার্মিক, সত্ এবং ভালো মানুষ হবে—আমরা এমনটাই মনে করি।

প্রোফাইল দেখে কিংবা পোস্ট পড়ে কাউকে এখন চেনা যায় না। প্রোফাইলে কেউ খারাপ কিছু ব্যবহার করে না। আল্লাহ-রসুলের বাণী ব্যবহার করে অথবা কোনো জাতীয় নেতার ছবি। রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মহাপ্রতারক সাহেদের কথা মনে পড়ছে। গণমাধ্যমের কাছে তিনি কী মহত্ ও বিজ্ঞই না ছিলেন! ভালো ভালো কথা বলতেন। কথার মধ্যে নীতি-নৈতিকতার ফোয়ারা বইত। বিভিন্ন টিভিতে মোটিভেশনাল কথাও বলেছেন। আবার সেগুলো তার পেজ এবং আইডিতে শেয়ারও করেছেন। ধরা পড়ার আগে কেউ কি জানত যে তিনি একজন বিশাল মাপের ভণ্ড প্রতারক? এভাবে আমাদের চারপাশ অসংখ্য ভণ্ড, প্রতারক রয়েছেন, যা আমরা নিজেরাই জানি না। কিন্তু আমরা এসব ভণ্ড সম্পর্কে না জেনেই তাদের মাথায় তুলে ফেলি।

অনেক অসত্ মানুষকে চিনি, যারা ভালো ভালো কথা বলায় ওস্তাদ। তাদের কথা শুনলে মনে হয় আমার সব মনের কথাগুলোই তিনি বলেছেন। পার্থক্য একটাই। তার লেখার সঙ্গে নিজের কোনো দিক থেকেই মিল নেই। এই ভেকধারী ভণ্ডদের অনেক ফ্যান-ফলোয়ারও জুটে যায়। বিভিন্ন কমেন্টে তাকে দিনে দিনে মহান বানিয়ে দেয়। আসলে তিনি কতটা মহান তা বলতে পারবে তার আশপাশের মানুষ।

ফেসবুক দেখে আসলেই বোঝা যায় না কে ভদ্র আর কে অভদ্র। ফেসবুকে সবাই সত্ ও সত্যবাদী। ধরা খেলে প্রতারক। তাই কারো ফেসবুক পোস্ট দেখে বিমোহিত হওয়া চলবে না। মানুষটাকে যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। তা না হলে ধর্ষকের মুখে ভালো ভালো বাণী শুনে বিভ্রান্ত হতে হবে।

কেউ কেউ মনে করেন, ফেসবুক হচ্ছে আধুনিক এক সর্বনাশা নেশার নাম। যে নেশায় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ বুঁদ হয়ে আছে। লাইক-কমেন্ট, আত্মপ্রচার, আত্মপ্রদর্শনীতে ডুবে থেকে ভুলে যাচ্ছে পারিপার্শ্বিকতা। আন্দোলন নেই, সংগ্রাম নেই, পড়া নেই, লেখা নেই, সৃজনশীলতার চর্চা নেই, গভীর ভাবনা নেই, আছে কেবল ভালো ভালো বাণী আওড়ানো আর বিচিত্র ভঙ্গিমায় তোলা অফুরন্ত ছবি। আমি ভালো, আমি সত্, আমি মহত্, আমি ভালো আছি, আমি সুখে আছি, আমাকে দেখো, আমাকে লাইক দাও, আমাকে অনুসরণ করো—এমনি ‘আমি’ আর ‘আমাকে’ দিয়ে গড়া ফেসবুক জগত্। বড়ই রঙিন আর আকর্ষণীয় এ জগত্। এই জগতে সবাই বুঁদ হয়ে আছে। আর তাতে চুরি হয়ে যাচ্ছে তার ভবিষ্যত্। এটা সম্ভবত অপরিণামদর্শী নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস করার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার!

পরিশেষে বহুল প্রচলিত একটি গল্প। মহিষ চুরি করা নাকি একজনের পক্ষে সম্ভব হয় না, কমপক্ষে তিন জন লাগে। একজন মহিষের গলার ঘণ্টা খুলে বাজাতে বাজাতে গ্রামের উত্তর দিকে রওনা হয়। দ্বিতীয় জন মহিষ নিয়ে গ্রামের দক্ষিণ দিকে যেতে থাকে, আর তৃতীয় জন ভালো মানুষ সেজে গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে যায়। ভালো মানুষ সাজা তৃতীয় চোর গ্রামের মানুষকে পরামর্শ দেয়, ঘণ্টার শব্দ যেদিক থেকে আসছে, মহিষ সেই দিকেই গেছে। বাজনাপ্রিয় গ্রামবাসী ঘণ্টার শব্দের দিকেই ছুটতে থাকে। ঘণ্টা নিয়ে যাওয়া প্রথম চোর নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে ঘণ্টা ফেলে দিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। গ্রামবাসী ঘণ্টা খুঁজে পেয়ে সেটা নিয়ে নানা কিসিমের আলোচনায় মশগুল থাকে। এই সুযোগে দ্বিতীয় চোর মহিষ নিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যায় আর ভালো মানুষ সাজা তৃতীয় চোরও কিছুক্ষণ পর সটকে পড়ে।

মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও ফেসবুক—আমরাও কি তবে এই ‘তিন চোর’-এর খপ্পরে পড়েছি?

হ লেখক: রম্য রচয়িতা

গণতান্ত্রিক সরকারের সর্বাপেক্ষা সহজ ও সরল সংজ্ঞাটিই হলো ‘ড়োবত্হসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ধহফ ভড়ত্ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব.’ অর্খাত্ সরকার হলো জনগণের, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য। এই সংজ্ঞা প্রদানকারী হলেন আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, যিনি দাসপ্রথা বাতিল করে বিশ্বমানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অসহায় ও নির্যাতিত কালোদের নাগরিক, মানবিক ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন।

তিনিই হলেন আমেরিকার একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যার কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। ১৮০৩ সালে গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মে ৯ বছর বয়সে মাকে হারান। পড়াশোনার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দারিদ্রে্যর কারণে রোজগারের জন্য স্কুল-কলেজে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজে নিজে পড়াশোনা করেই আইনজীবী হয়েছিলেন তিনি।

ফেডারেল সরকারব্যবস্হা বহাল এবং দাসপ্রথা বিলুপ্তকরণের নিমিত্তে দীর্ঘ সিভিল ওয়ারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ কারণে তিনি শীর্ষস্হানীয় প্রেসিডেন্টদের একজন। দেশের প্রতি প্রেসিডেন্টদের অবদানের গুরুত্ব বিবেচনায় আমেরিকার চার জাতির জনকের প্রথম জন জর্জ ওয়াশিংটনের পরেই তাকে দ্বিতীয় স্হানে (ঝবপড়হফ জধহশবফ) রাখা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধিকাংশ জনগণ তাকেও অন্যতম জাতির জনক হিসেবে গণ্য করেন।

অভাবের তাড়নায় নৌকার মাঝি ও স্টোর ক্লার্কের চাকরিও করেন। যৌবনে ব্ল্যাক হাউক যুদ্ধে মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ শেষে ব্যবসায় লস দিয়ে সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। পোস্ট অফিসে ক্লার্কের চাকরি করেন দীর্ঘদিন। পোস্ট অফিসের চাকরি হারিয়ে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাক্টিস শুরু করেই অনেক ভালো আয়-রোজগার করেন। ১৮৩১ সাল থেকে বেশ কয়বার স্টেট অ্যাসেম্বলির পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। এর পরও থেমে থাকেননি লিংকন। ১৮৩৮ সালে আবার স্টেট অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচন করে পরপর চার বার জয়লাভ করেন। স্টেট অ্যাসেম্বলির স্পিকার পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। কংগ্রেসের রিপ্রেজেনটেটিভ পদে দুই-দুবার নমিনেশন পেতে ব্যর্থ হন। তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি ১৮৪৮ ও ১৮৫৪ সালে দুবার সিনেটে পরাজিত হন। তবু থেমে থাকেননি অদম্য লিংকন। এতগুলো পরাজয়ের গ্লানি কাটিয়ে ১৮৬০ সালের অভূতপূর্ব ও ঐতিহাসিক নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৮৬৪ সালে বিপূল ভোটে পুনর্নির্বাচিত হয়ে ৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙে এন্ডরো জেকসনের পর তিনিই রিপাবলিকান হিসেবে দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ করেন। ‘ঋধরষঁত্ব রং ঃযব ঢ়রষষধত্ ড়ভ ংঁপপবংং’ এবং ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’—এ দুটি প্রবাদই তার বেলায় সত্য প্রমাণিত হয়। ‘ঘড়ঃযরহম াধষঁধনষব পধহ নব ষড়ংঃ রহ ঃধশরহম ঃরসব.’ নিজ জীবনের আলোকেই করা তার বিখ্যাত উক্তি (য়ঁড়ঃব)।

১৮৫০ সাল থেকেই সারা আমেরিকা ফেডারেল সরকারব্যবস্হা, স্টেটের স্বাধীনতা ও ক্রীতদাস রাখা-না রাখার প্রশ্নে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অশান্ত হয়ে পড়ে রাজনীতি। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দুটি দলও নিজেদের মধ্যেই নর্থ সাউথ দুই ভাগে বিভক্ত হয়। ফলে ১৮৬০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুই দলেরই দুটি করে প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ফেডারেলিজম বহাল ও দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার পক্ষে এক প্যানেল ও বিপক্ষে আরেক প্যানেল। ইতিমধ্যে রিপাবলিকানদের মধ্যে দাসপ্রথা বিলোপের পক্ষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই নর্থের স্টেটসমূহেই লিংকন ডেমোক্র্যাটের বিপক্ষে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হোন।

সাউথের রাজ্যগুলো বাদেই লিংকন ৩০৩ কলেজ ভোটের ১৮০ কলেজ ভোট এবং শতকরা ৪০ ভাগ পপুলার ভোট পেয়ে নিজ দলের অর্জনসহ তিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হোন।

১৮৪০ সালে একটি ড্রান্স ক্লাবে ধনীর দুলালী সুন্দরী মেরি টডের সঙ্গে পরিচয় হলে লিংকনের প্রস্তাবেই একসঙ্গে নাচেন দুজন। তরুণী মেরি হালকা গড়নের চিকন, লম্বা বুদ্ধিদীপ্ত, হিউমারাস ও মায়াবী লিংকনের প্রেমে পড়ে যান সেদিনই। দাসপ্রথার পক্ষে থাকা, কনফেডারেট ধনী পরিবারের প্রচণ্ড বাধা সত্ত্বেও মেরি টড পরিবার ছেড়ে টগবগে যুবক লিংকনকে ১৮৪২ সালে বিবাহ করেন। তাদের চার সন্তানের তিন জনই অল্প বয়সেই মারা যায়। তৃতীয় সন্তান কোনো উত্তরাধিকার না রেখেই মারা গেলে একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিবারের বিলুপ্তি ঘটে।

লিংকন এবোলোশনিস্ট ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ‘ধষষ সবহ ধত্ব বয়ঁধষ রহ ঃযব বুব ড়ভ ষধ‌ি’ প্রতিশ্রুতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে দাসপ্রথা বিলোপের এবং ফেডারেল সরকারব্যবস্হা কার্যকর ও শক্তিশালী করতে সাউথের স্টেটসমূহে সৈন্য পাঠান। শুরু হয় যুদ্ধ, সিভিল ওয়ার। অধিকাংশ স্টেটকেই ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। নিহত সেনাদের সম্মানে আয়োজিত ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে মাত্র ২৭২ শব্দের গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্হার সংজ্ঞা টেনে সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন। তিনি আরো বলেন, সিভিল ওয়ারে শহিদেরা নিজেদের জন্য নয়, দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে নতুন স্বাধীনতা দিয়ে গেলেন, আমাদের তা রক্ষার শপথ নিতে হবে এবং গণতন্ত্র ও সবার জন্য আইন সমানভাবে কার্যকর করে তাদের অসমাপ্ত কাজ সবাই মিলে সম্পন্ন করতে হবে।

১৮৬৫ সালের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট শপথের কিছুদিন পরই শেষ কনফেডারেট জেনারেল (দাসপ্রথার পক্ষ) জন রবার্ট লি আত্মসমর্পণ করলে সিভিল ওয়ারের পরিসমাপ্তি ঘটে। এদিকে প্রেসিডেন্টসহ রাষ্ট্রের ভিভিআইপিদের নিরাপত্তার জন্য সিক্রেট সার্ভিস আইনটি তখনো তার টেবিলে স্বাক্ষরের অপেক্ষায়। পরের দিন ১৪ এপ্রিল ওয়াশিংটন ডিসির ফোর্ড থিয়েটারে টম টেইলরের ‘ঙঁত্ অসবত্রপধহ পড়ঁংরহ’ নাটক দেখাকালে আততায়ী জন উইলকিস বোথ তাকে মাথায় গুলি করে পালিয়ে যান। পরদিন তিনি মারা যান। টম টেইলরের থিয়েটারের প্রচণ্ড ভক্ত ছিলেন তিনি। আততায়ী বোথ ছিলেন কনফেডারেট যোদ্ধা, দাসপ্রথা বহালের পক্ষে। তিনি ছিলেন একটি প্রখ্যাত নাট্য অভিনেতা পরিবারের সদস্য। হত্যাকাণ্ডের সময় তার দেহরক্ষী তার কাছে ছিল না। এটা ছিল শতভাগ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। হত্যাকাণ্ডের তালিকায় লিংকনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এন্ড্র~ জনসন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিউওয়াও ছিল। হত্যাকারী বোথও পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। সাত সপ্তাহের দীর্ঘ বিচারে ৩৬৬ সাক্ষীর পর্যালোচনায় ষড়যন্ত্রকারী বাকি চার আসামির মৃতু্যদণ্ড এবং চার জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

তার রাজনৈতিক জীবন ও হত্যাকাণ্ড জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পরিক্রমা ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অদ্ভুত এক মিল। দুই জাতীয়তাবাদী নেতাই সমাজের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও মেহনতি মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দুটি সশস্ত্র যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে জয়ী হলে পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে ষড়যন্ত্রমূলক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন।

তিনি ১৮৬০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে নিহত হলেন ১৫ এপ্রিল ১৮৬৫ সালে এবং বঙ্গবন্ধু ১৯৭০-এ জয়ী হয়ে নিহত হলেন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ। দুজনেই দুই দেশের জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃত।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ও লিংকনের গেটিসবার্গের ভাষণ দুটিই জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ ও বিশ্বসম্পদ।

লেখক: চিররঞ্জন সরকার, যুক্তরাষ্ট্র ফেডারেল সরকারের কর্মকর্তা


এই বিভাগের আরো খবর

Leave a Comment