শফিক জামান ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স মাস্টার্স করে ৫ বছর আগে শহরের একটি বেসরকারী কলেজে ঢুকেছে। থাকেন পৈত্রিক বাড়ি শহরের নাগ পাড়ায়। বাংলার ছাত্র হওয়ার কারণে লেখালেখির হাত খুব ভালো তার। তবে কোন বই প্রকাশিত হয়নি। ফেইস বুকে মাঝে মধ্যে কবিতা ও সচেতন মূলক পোষ্ট দেন প্রায়ই। সে কারণে শহরের বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের পাশপাশি সারা দেশের অনেক অপরিচিত লেখক তার আইডির ফ্রেন্ডলিস্টে রয়েছে। তার লেখায় যদি কেউ কমেন্টস করে সেও তার লেখাতেও লাইক-কমেন্ট করে। এরকম অপরিচিত ফ্রেন্ডদের মধ্যে রোমানা জান্নাত একজন। রোমানা ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে ভুটানিতে অনার্স পড়ছে। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা। ভুটানির শিক্ষার্থী হলেও তারও বেশ ক্ষুরধার লেখা শফিকের বেশ ভালো লাগে। প্রতিটি লেখায় সে কমেন্ট করে। বাস এতটুকুই পরিচিতি তাদের মধ্যে।
হঠাৎ একদিন মেসেঞ্জারে রোমানার হাই লেখা দেখে শফিক হ্যালো লিখলো। এভাবেই তাদের সাথে কেবল মাত্র লেখালেখির নানা বিষয়ে কথা হয় মাঝে মধ্যে। দীর্ঘ দুই বছর কেটে যায় তাদের মেসেস আদান প্রদানে। ইতিমধ্যে উভয়ই তাদের সকল পরিচিতি শেষ করেছে। এরই মধ্যে একদিন শফিক রোমানাকে মেসেজ করেন, ‘আচ্ছা আমি তো প্রায়ই আমার ছোট বোনের বাসায় ময়মনসিংহে যাই। আমি যদি আপনার সাথে দেখা করতে চাই তবে কী আপনি দেখা করবেন?’ উত্তরে রোমানা জানায়, ‘ আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আপনি যখন নক দিবেন, তখন যদি আমি ফ্রি থাকি তবে।’ এভাবেই তাদের মধ্যে মেসেজ আদান প্রদানের এক পর্যায়ে একদিন সকাল বেলা শফিক রোমানাকে মেসেজ করেন, ‘আজ দুপুরে ময়মনসিংহে আমার বোনের বাসায় যাচ্ছি। সেখানে বোনের সাথে দেখা করে বিকেলের বাসে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় যাবো কলেজের একটি কাজে। আপনি কী আজ বিকেলে ফ্রি থাকবেন? ফ্রি থাকলে জয়নাল পার্কে আসলে কফি খাওয়াবো আপনাকে।’ শফিক এ মেসেজটি যখন লিখে তখন রোমানা অনলাইনে ছিলো না। সকাল থেকেই সে অফলাইনে রয়েছে। তবুও শফিক ভাবলো যখনই রোমানা মেসজ সিন করবে তখনই হয়তো উত্তর টা লিখবে। তখন শফিক পরবর্তি সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
এসব কথা ভেবে বেলা ১১ টায় শেরপুর থেকে ময়মনসিংহের উদ্যেশে রওনা হলেন। বাসে বসে বসে শফিক একটু পর পর রোমানার অনলাইনে আসার অপেক্ষা করছে আর মনে মনে ভাবছে, এতো দিন হলো রোমানার সাথে চেটিং হয়, অথচ আজ পর্যন্ত তার মোবাইল নাম্বারটা নেয়া হলো না। আজ নাম্বার টা থাকলে সরাসরি ফোনই করা যেতো। ভাবছে আর মোবাইলেও মেসেঞ্জারে চোখ রাখছে একটু পর পর। কিন্তু না ময়মনসিংহে চলে আসলেও রোমানাকে অনলাইনে পেলো না। এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। বোনের বাসায় দুপুরের খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিলো আর ভাবছিলো মেয়েটা কেমন, এখনও অফলাইনে থাকতে হয়, একটু অনলাইনে আসলেই তো তার সাথে দেখা হবে কী না তার ফয়সালা হয়ে যেতো। শফিককে আবার সন্ধ্যার পরপরই ঢাকা পৌঁছে হবে। তাই এক পর্যায় শফিক বিছানা থেকে উঠে বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্যেশে বেড়িয়ে পড়লো মাশকান্দা এনা বাস কাউন্টারে।
সেখানে গিয়ে বিকেল ৪ টার বাসের টিকিট কেটে সি-৩ সিরিয়াল সিটে গিয়ে বসলো। ৫ মিনিটের মধ্যে বাস ছেড়ে দিবে বিধায় শফিক টিকিট কেটে বাইরে দাড়িয়ে না থেকে সরাসরি বাসের সিটে গিয়ে বসলো। জানালার পাশে হকারদের হাক-ডাক তার কাছে বিরক্ত মনে হচ্ছে। মনে মনে রোমানার প্রতিও বিরক্ত- মেয়েটার আজ কী হলো, সকাল থেকে এফবিতে নাই। কোন সমস্যা হয়েছে কী না, না কী কোন পরীক্ষার কারণে আজ এফবিতে নেই। এসব নানা কথা ভাবতেই বাস ছেড়ে দিলো। হঠাৎ তার পাশের সি-১ নাম্বার সিটে অর্থাৎ জালানার পাশের সিটে একটি মেয়েকে দেখে চমকে উঠলো শফিক। রোমানার মতো মনে হচ্ছে। রোমানার পাশের সিটে অর্থাৎ সি-২ নাম্বারে অন্য একজন বয়স্ক মানুষকে দেখে ভাবলো তার বাবা হয়তো হবে। কিন্তু শফিক শিউর হওয়ার জন্য এফবির তার প্রোফাইলে ঢুকে ছবি দেখে তার চেহারা মেলাতে লাগলো। যদিও এফবিতে মেয়েদের ছবি আর বাস্তবে মেলানো খুবই কঠিন। তবুও অনেকটা সিউর করা যায় ছবির মানুষ আর বাস্তবের মানুষকে। কিন্তু মেয়েটি একটি বই পড়ছিলো বেশ মনোযোগ দিয়ে। এতে কিছুটা সিউর হলেও শফিক এফবির ছবি দেখছিলো বার বার।
রোমানা বাস্তবে প্রচুর বই পড়ে এবং চমৎকার সচেতন মূলক ও জ্ঞানী কথাবার্তা পোষ্ট করেন এফবিতে। বই পড়লেই আসলে এতো জ্ঞানী কথা লিখা যায়। শফিক খুব একটা কাগজের বই না পড়লেও অনলাইনে পড়ার অভ্যাস আছে। অনেকক্ষণ পর শফিক নিশ্চিত হলো এই মেয়েই রোমানা। কিন্তু সে এতোটাই মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলো যে, আশাপাশে কী হচ্ছে বা বাস কখন ছেড়ে কোন পর্যন্ত গিয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। বইয়ের মধ্যে বুদ হয়ে পড়েছে। বোধ হয় এই বই পড়েই আজ ঢাকা পৌঁবে। কিন্তু অনলাইনে না আসলে তো এই মেয়েই রোমানা কী না তা শতভাগ নিশ্চত হওয়া যাবে না। এসব নানা কথা ভাবছে আর অস্থির হয়ে পড়েছে শফিক। জালানার পাশের কিলোমিটারের দিকে তাকাচ্ছে আর দেখছে ঢাকা ৮০ কিলোমিটার একটু পর ৬০ কিলোমিটার। এদিকে কিলোমিটারের পিলার গুনতে গুনতে তার হৃদয়ের হার্ট বিটও বেড়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কারণ একটু পর ঢাকা মহাখালি চলে আসলে রোমানার সাথে আর কথাও হবে না, নিশ্চত পরিচয়টাও জানা যাবে না, সেই কী রোমানা ? রোমানা এ পর্যন্ত এফবিতে তার মাত্র দুই টি ছবি পোষ্ট করেছে, বাকী সব নানা ফুল, প্রকৃতির বিভিন্ন সিনারি, আর নানান লেখা। রোমানার গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণের হলেও টানা টানা চোখ আর হালকা চেপ্টা নাক তার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মাথা ভড়া কালো কুচকুচে চুল অনেকটা বনলতা সেনের সাথে তুলোনা করা যায় তাকে।
চৌরাস্তায় এসে জ্যামে পড়ে গরমে অস্থির হয়ে উঠলো বাসের সবাই। হঠাৎ তখন রোমানা তার বইটি ব্যাগে ভরে মোবাইলে হাত দিলো। এ দৃশ্য দেখে শফিকের দেহে যেনো প্রাণ ফিরে এলো। হ্যা তাই। রোমানা অনলাইনে ঢুকেই শফিকের মেসেজের জবাব দিলো, ‘স্যারি আমি সকাল থেকেই পারিবারিক এক ঝামেলায় পড়ে নেট চালু করতে পারিনি। আমি জরুরী কাজে ঢাকায় যাচ্ছি। এবার আর আপনার সাথে দেখা হবে না। অন্য কোন দিন দেখা হবে নিশ্চয়। ভালো থাকবেন।’ এ মেসেজ পেয়ে শফিক হঠাৎ করে সে একটু কৌসুলী হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘ট্রেনে যাচ্ছেন বুঝি।’ রোমানার উত্তর, না, হঠাৎ করে ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ায় ট্রেনের টিকিট পাওয়া দুষ্কর, তাই বাসেই যাচ্ছি।’ শফিক আবার কৌশলী প্রশ্ন, ‘ ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় তো ‘এনা’ ছাড়া ভালো কোন বাস নেই।’ রোমানা আমার লিখছে, ‘হ্যা আমি এনাতেই যাচ্ছি, বিকেল ৪ টায় বাস ছেড়েছে এখন সন্ধ্যা ৬ টা বাজে, চৌ-রাস্তার জ্যামে বসে আছি।’ শফিক তখন শত ভাগ নিশ্চত হলো তার পাশের মেয়েটাই রোমনা। তবে সে একই বাসে তারই পাশের সিটে বসে আছে সেটা সরাসরি না বলে কোথায় নামবে জিজ্ঞেস করে আগে, ‘কোথায় নামবেন, সাথে আর কে যাচ্ছে ?’ আমি তো ময়মনসিংহে একাই থাকি। আর কে যাবে সাথে? আমি একাই। নামবো খিলক্ষেতে।’
রোমানার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা সেটা শফিক আগে থেকেই জানে। তাই ঢাকায় কার ওখানে যাচ্ছে এবং কী কাজে যাচ্ছে সেটা কৌশলে কীভাবে জিজ্ঞেস করবে সেটা ভাবতেই- রোমানার শেষ মেসেজ ‘খুব টায়ার্ড লাগছে একুট ঘুমিয়ে নিই। পরে কথা বলছি। স্যারি কিছু মনে করবেন না।’ একথা লিখেই নেট বন্ধ করে দিয়ে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। তবে শফিক এতোটুকু জানতে পারলো যে, পাশের সিটের বয়স্ক লোকটি তার বাবা নন এবং খিলক্ষেত নেমে যাবে। বাস তখন টঙ্গি পার হচ্ছে। শফিক আবারও ফাঁপড়ে পড়ে গেলো, ইস কেন যে খুলে বললাম না, আমিও আপনার পাশের সিটে বসে ঢাকায় যাচ্ছি। এসব নানা কথা ভাবছে আর আফসোস করছে। কিন্ত পাশের বয়স্ক লোকটি যদি তার বাবা হতো তবে কী সে আমার সাথে কথা বলতে পারতো। যাই হোন ঘুমোতে থাকুক খিলক্ষেত আসালে আমিই ডেকে দিবো। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই এয়ারপোর্ট এসে গেলো।
শফিক প্রস্তুতি নিয়েই ফেললো, রোমানার নাম ধরে ডেকে তার পরিচয় দিয়ে কথা বলবে। কিন্তু বিধি বাম, সুপারভাইজারকে আগে থেকেই বলে রাখায়, তিনি এসে জাগিয়ে দিলেন, ‘আপা উঠেন সামনে খিলক্ষেত।’ একথা শুনে রোমানা ঝটপট উঠে ব্যাগ গুছিয়ে সামনের দিকে চলে গেলো। কিন্তু শফিকের আর পরিচয় দেয়া হলো না। শফিক রোমানাকে মনে মনে গালি দিচ্ছে, ‘কেমন কসাই মেয়ে রে বাবা, আমার দিকে একটু তাকালেই তো হয়ে যেতো। আমাকে এক নজর দেখলোও না। যাই হোক, নেমে যাক, পরে বিষয়টা খুলে বলবো।’ এসব কথা ভাবতেই বাস থামলো খিলক্ষেত। শফিক তখন জানালা দিয়ে দেখছিলো কে তাকে নিতে আসে। একজন ইয়াং ছেলেকে দেখলো রোমানাকে বাইকের পেছন বসিয়ে নিয়ে গেলো। ভাবলো তার ভাই বা নিকট আত্মিয় বোধ হয়। এভাবে কিছুক্ষণ নানা কিছু ভাবতেই রোমানার নক, ‘এই মাত্র ফিরলাম বাসায়। খুব টায়ার্ড আজ আর কথা বলতে পারছি না। ফ্রেস হয়ে ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়বো।’ এ মেসেজ দেখে, শফিকের প্রশ্ন, ‘কে ছিলো আপনার সাথে, যিনি আপনাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে নিয়ে গেলেন ?’ রোমানার পাল্টা প্রশ্ন, ‘আপনি আমাকে দেখলেন কোত্থেকে, আপনি এখন কোথায় ?’ তখন বাধ্য হয়েই শফিক মেসেজ করলো, ‘আমি তো আপনার পাশের সিটেই বসে ঢাকা আসলাম। একটিবারের জন্য ডানে তাকালেন না। আমাকে দেখবেন কীভাবে? আমিতো আপনাকে বাস্তবে দেখিনি কোনদিন। তাই এফবির ছবি দেখে কী নিশ্চত হওয়া যায় যে আপনিই সেই এফবি’র রোমানা জান্নাত ? আর আপনার পাশের বয়স্ক লোককে তো আমি আপনার বাবা ভেবে সরাসরি কথা বলতে সাহস পাইনি। যদিও পরে জানতে পেরেছি, তবে তখন আপনি নেট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লেন। যাইহোক আপনাকে কে নিয়ে গেলো তার পরিচয় তো দিলেন না।’
রোমানার উত্তর দেখে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো শফিকের। রোমানা জানায়,‘গত মাসে হঠাৎ করেই আমার কাবিন হয়েছে পারিবারের ইচ্ছেতে। আমি আমার অনার্স শেষ করার সুযোগ চেয়েও পাইনি। মফস্বলের মেয়ে তাই মা-বাবার মুখের উপর কথা চলে না। আজ সকালে মামা ফোন করে জরুরী ভাবে ঢাকায় আসতে বলেছে। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই তারা আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থান করছিলো। পাত্র একজন ব্যাংকার। যমুনা ব্যাংকের গুলশান শাখার সিনিয়র অফিসার। সম্পর্কে তিনি আমার মামার বন্ধুর ছেলে। ওই ছেলেটিই আমাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে নিয়ে গেলো। কথা ছিলো আগামী মাসে ঈদের পরই আমাদের ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি কয়দিন আগে স্ট্রোক করেছে। সে এখন ছেলের বউকে বাড়িতে দেখতে চাচ্ছে। তাই সেই ধুমধাম অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে পরশু শুক্রবারই মামার বাড়িতে ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে বর পক্ষ। যাই হোক, ময়মনসিংহে গিয়ে আপনার সুবিধা মতো ময়মনসিংহে আসলে একদিন আমার বিয়ে উপলক্ষে আমিই ট্রিট দিবো আপনাকে। আল্লা হাফেজ।’
শফিকের তখন মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কী আর করা রোমানাকে সে মনে মনে শুধু ভালোবেসে গেছে, কোন দিন তাকে তার মনের কথা বলা হয়নি। মেসেজে শুধু একে অপরের লেখালেখির প্রশংসা করেই তাদের সময় কেটে গেছে। এফবির পাতা উল্টাতেই বহুল আলোচিত ও ভাইরাল হওয়া ‘হাওয়া’ ছবির গানটি ভেসে এলো, ‘তুমি বন্ধু কালা পাখি, আমি জেন কী, বসন্তকালে তোমায় বলতে পারিনি’। বুকের ভিতর শত কষ্টকে বরফ করে হেড ফোন দিয়ে গানটি শুনতে শুনতেই শফিকের বাস মহাখালি বাসস্ট্যান্ডে প্রবেশ করে। এদিকে শফিকের হৃদয়ের স্ট্যান্ডে হয় তখন কষ্টের নোঙর করে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক, শেরপুর।